মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওহাব নজদীকে তার ভাইয়ের হুঁশিয়ারি:
নিচে শাইখ সুলাইমান ইবন ‘আব্দুল ওহহাব (রহ.) এর লিখিত বিখ্যাত গ্রন্থ ❝الصواعق الإلهية في الرد على الوهابية❞ এর নির্বাচিত অংশসমূহের বাংলা অনুবাদ দেওয়া হলো। তিনি এই পুস্তিকায় তাঁর ভাই মুহাম্মদ ইবন ‘আব্দুল ওহহাবের আকীদা ও দাওয়াতের ব্যাপারে কঠোর সমালোচনা করেছেন এবং এটিকে বিভ্রান্তি, উগ্রতা ও উম্মতের মূলধারা থেকে বিচ্যুতি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
১. মানুষকে কাফের বলা প্রসঙ্গে:
❝তুমি কীভাবে এমন ব্যক্তিকে কাফের বলো, যে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ সাক্ষ্য দেয়, নামায পড়ে, রোযা রাখে এবং নিজেকে মুসলমান দাবি করে, অথচ তার থেকে স্পষ্ট কোনো কুফরি প্রকাশ পায়নি?! তুমি কী মনে করো কুফরের হুকুম কেবল ধারণা ও কল্পনার উপর ভিত্তি করে দেয়া যায়?❞
২. মুসলমানদের রক্ত হালাল করা প্রসঙ্গে:
❝তুমি মানুষকে কাফের বলো, তাদের রক্ত প্রবাহিত করো, তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো এবং বলো— এটি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ! না, বরং এটি শয়তানের রাস্তায় জিহাদ! ধ্বংস তোমার জন্য, তুমি যা করছো তার কারণে!❞
৩. তাওয়াসসুল ও কবর যিয়ারত প্রসঙ্গে:
❝তুমি কি সেই ব্যক্তিকেও কাফের বলো, যে নবী ﷺ এর দ্বারা তাওয়াসসুল করে, অথবা তাঁর কবর যিয়ারতে গিয়ে সেখানে দোয়া করে?! সাহাবা ও তাবেয়ীনদের মধ্যে কি কেউ এর বিরোধিতা করেছে?! বরং তারাও এ কাজ করতেন।❞
৪. এককভাবে তাওহীদের দাবিদার হওয়া প্রসঙ্গে:
❝তুমি দাবি করো যে, একমাত্র তুমিই তাওহীদে বিশ্বাসী, আর বাকি সব মুসলমান মুশরিক! তবে কি তোমার উপর আকাশ থেকে ওহি নাজিল হয়েছে?! বরং এটি অহংকার ও ধৃষ্টতার চূড়ান্ত রূপ, যা খারিজিদের বৈশিষ্ট্য।❞
৫. উলামায়ে কেরামের পথ থেকে বিচ্যুতি প্রসঙ্গে:
❝তুমি কি ইমাম আহমদের উক্তি পড়োনি— 'যে ব্যক্তি কিবলার অনুসারীদের কাফের বলে, সে নিজেই কাফের'? অথচ তুমি তো নির্দ্বিধায় বলো, এবং সমগ্র মুহাম্মাদী উম্মতকে কাফের ঘোষণা করো!❞
৬. অজ্ঞতা ও খেয়াল-খুশির অনুসরণ প্রসঙ্গে:
❝তোমার গভীর অজ্ঞতা তোমাকে এমন গহ্বরে ফেলে দিয়েছে, যেখানে কোনো আলেমই পড়েননি। তুমি এমনকি বড় বড় আলেমদেরকেও শুধু ভিন্নমত পোষণ করার কারণে কাফের বলো, এবং পুরো উম্মতের কথা মিথ্যা বলে উড়িয়ে দাও!❞
৭. তার মাযহাবের প্রকৃতি প্রসঙ্গে:
❝তোমার মাযহাব গঠিত হয়েছে কঠোরতা, অজ্ঞতা, মুসলমানদের প্রতি সন্দেহ, এবং দলীল ছাড়া তাদেরকে কাফের বলে ফতোয়া দেয়ার উপর। আর এসব বৈশিষ্ট্য খারিজিদের, তাওহীদবাদীদের নয়।❞
৮. তাওয়াসসুলকারীর বিরুদ্ধে কুফরের ফতোয়া প্রসঙ্গে:
❝যদি তুমি বলো: যে ব্যক্তি বলে ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ’, সে মুশরিক হয়ে গেল— তাহলে তুমি সমগ্র উম্মতের ওপর কুফরের ফতোয়া দিয়েছো। আর এটি কেবল একজন মুনাফিক, গোমরাহ বা পাগলের কাজ হতে পারে।❞
৯. মু’মিনদের পথ থেকে বিচ্যুতি প্রসঙ্গে:
❝তুমি এমন এক পথে চলেছো, যা না পূর্বসূরীরা (সালাফ), না পরবর্তীরা (খালাফ) অনুসরণ করেছে। তাহলে কি তুমি হেদায়াতে আছো আর তারা ভ্রান্তিতে?! সুবহানাল্লাহ! কত বড় মিথ্যাচার!❞
১০. উপদেশ স্বরূপ:
❝তোমার নিজের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো, এবং এই দায়িত্বহীনভাবে তাকফির (অন্যদের কাফের বলা) থেকে বিরত হও। এটাই সালাফদের পথ নয়। বরং এটি গোমরাহপন্থী ও অতিরঞ্জনকারী লোকদের পথ, যারা নিজেরাও পথভ্রষ্ট হয়েছে এবং অন্যদেরকেও বিভ্রান্ত করেছে।❞
শাইখ সুলাইমান ইবন ‘আব্দুল ওহহাব নজদী রহিমাহুল্লাহ সম্পর্কে বিস্তারিত_
🔹 নাম ও পরিচয়:
নাম:
الشيخ سليمان بن عبد الوهاب بن سليمان بن علي التميمي النجدي الحنبلي
মাযহাব:
হানবলী
জন্মস্থান ও বসবাস:
নাজদ, আরব উপদ্বীপ (বর্তমান সৌদি আরবের অন্তর্ভুক্ত অঞ্চল)
চাকুরী:
নাজদের একজন প্রখ্যাত কাজি (বিচারক) এবং মুহাদ্দিস ও ফকীহ ছিলেন। তিনি ছিলেন তাঁর সময়ের একজন প্রসিদ্ধ আলেম এবং ইসলামের মূলধারার (আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ) অনুসারী।
🔹 তাঁর প্রসঙ্গে প্রাচীন ঐতিহাসিকদের উক্তি:
1️⃣ ইবনু বাশর (ت 1290هـ) বলেন তাঁর গ্রন্থ عنوان المجد في تاريخ نجد–এ:
❝وكان من أهل العلم والدين، مشهورًا بالفضل والمعرفة في بلده.❞
"তিনি ছিলেন ইলম ও দীনের মানুষ, তাঁর এলাকায় জ্ঞান ও ফজিলতে প্রসিদ্ধ ছিলেন।"
📚 عنوان المجد في تاريخ نجد، لابن بشر، ج1، ص 121.
2️⃣ আল্লামা শাইখ আব্দুল্লাহ ইবন ঈসা (ت 1340هـ) তাঁর تاريخ بعض الحوادث في نجد–এ লেখেন:
❝وكان الشيخ سليمان من العلماء المعروفين في نجد، وله اليد الطولى في القضاء والتعليم.❞
"শাইখ সুলায়মান নাজদের পরিচিত আলেমদের একজন ছিলেন, বিচার এবং শিক্ষায় ছিল তাঁর অসামান্য ভূমিকা।"
📚 تاريخ بعض الحوادث في نجد، للشيخ عبدالله بن عيسى، ص ٣٢.
3️⃣ ড. আব্দুল্লাহ আল-উমরান তাঁর পিএইচডি গবেষণায় উল্লেখ করেন:
❝الشيخ سليمان بن عبد الوهاب من كبار علماء الحنابلة في زمانه، وله مؤلفات في الرد على أخيه، تبيّن عمق علمه وتمسّكه بمنهج أهل السنة.❞
"শাইখ সুলাইমান ইবন ‘আবদুল ওহহাব তাঁর সময়ের প্রখ্যাত হানাফী আলেমদের একজন ছিলেন, যাঁর রচনাবলি তাঁর গভীর জ্ঞান ও আহলুস সুন্নাহর প্রতি অটল অবস্থান প্রমাণ করে।"
📚 رسالة دكتوراة، جامعة الإمام محمد بن سعود الإسلامية، كلية أصول الدين.
🔹 তাঁর বিখ্যাত রচনাঃ
الصواعق الإلهية في الرد على الوهابية
এই রিসালাহটিতে তিনি তাঁর ভাই মুহাম্মদ ইবন ‘আবদুল ওহহাবের তথাকথিত 'তাওহীদের' দাওয়াতের বিরুদ্ধে দ্বীনি ও ফিকহি দলীলসহ গুরুতর আপত্তি তুলেন।
🔹 দুই ভাইয়ের দাওয়াতের পার্থক্য:
শাইখ সুলাইমান ছিলেন মূলধারার আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ মতবাদের অনুসারী।
আর তাঁর ভাই মুহাম্মদ ইবন ‘আবদুল ওহহাব একটি নতুন চরমপন্থী দাওয়াত শুরু করেন, যা পরবর্তীতে "ওহহাবিয়াত" নামে পরিচিত হয়।
✍️ সংক্ষেপে:
শাইখ সুলাইমান ইবন ‘আবদুল ওহহাব ছিলেন ইলম, বিচার ও দীনদারির ক্ষেত্রে প্রসিদ্ধ এক আলেম। তাঁর রচনা “الصواعق الإلهية” এক ঐতিহাসিক দলিল, যা উম্মতের অনেক ফিতনার বিরুদ্ধে আলোকবর্তিকা হিসেবে বিবেচিত হয়।
সংকলনে: জিহাদ মাহমুদ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন